Posts

হুমায়ূন আহমেদ - দ্যা ম্যান অফ সারপ্রাইজেস

হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করতেন, শুধু দিতে নয় পেতেও পছন্দ করতেন। আসলে এই সারপ্রাইজিংয়ের ব্যাপারটা ছিল ভালোবাসারই ভিন্ন এক রূপ।
হুমায়ূন আহমেদ - ম্যান অব সারপ্রাইজ







শহিদ হোসেন খোকন:
হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করতেন, শুধু দিতে নয় পেতেও পছন্দ করতেন। আসলে এই সারপ্রাইজিংয়ের ব্যাপারটা ছিল ভালোবাসারই ভিন্ন এক রূপ। যারা তাঁর কাছাকাছি ছিলেন ব্যাপারটা তাদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছিল।

স্যার নিজেই লিখে গেছেন তাঁর মেয়ে নোভার বিয়ের কথা - মেয়েকে বিয়েতে একটা ভাল কিছু উপহার দিতে হবে যাতে সারাজীবন সে উপহারের কথা মনে রাখে। সবচেয়ে ভাল হয় নোভার প্রিয় কোন জিনিস তার সামনে হাজির করা - আনএক্সপ্যাক্টেড কোন গিফট - যাতে তাকে সারপ্রাইজ দেয়া যায়। নোভার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যে করেই হোক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির করতে হবে। হুমায়ূন আহমেদ তার সবচেয়ে কাছের মানুষ মাজহারুল ইসলামকে ডেকে তাঁর অভিপ্রায়ের কথা জানালেন।

বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন, এটা হল লাস্ট মিনিটের ডিসিশন। হুমায়ূন আহমেদের কথা শুনেই সুনীল সস্ত্রীক আসতে রাজি হলেন! মাজহারুল ইসলাম ছুটল এয়ারপোর্টে, সেখান থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে সোজা বিয়ের আসরে। কনে বিয়ের মণ্ডপে বসে আছে, তার মন খুব খারাপ। বাবার সঙ্গে কিছুদিন আগে বিছ্রি একটা ঝগড়া হয়েছে। তারপর বাবা-মা, ভাই বোন আর নিজের এত দিনের চেনা সংসার ছেড়ে নতুন সংসারে যেতে হবে, মনে নানা আশঙ্কা। এসময় মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো - কেমন আছ মা?

লোকটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু নোভা ঠিক মনে করতে পাড়ছে না আগে কোথায় এঁকে দেখেছে। বাবার প্রকাশক আর নাটকের সব বন্ধুদের নোভা চেনে। তবে সামনে দাঁড়ানো লোকটার সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চেহেরার অনেক মিল আছে । নোভার হঠাৎ মনে হল তার সামনে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে সে আসলে অন্য কেউ নয় স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

নোভা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, বাবা তার জন্যে এত বড় একটা সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করে রেখেছেন এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। এক ধরনের অদ্ভুত ভালোলাগায় নোভার মন ছেয়ে গেল, সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। বাবা হুমায়ূন আহমেদ দূর থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। এই হলো হুমায়ূন আহমেদের সারপ্রাইজের নমুনা।

একদিন দুপুরে মাজহারুল ইসলামের অফিসে বসে আড্ডা হচ্ছে, সাথে লাঞ্চ। নাসরিন জাহানের রান্না করা বিখ্যাত সরিষা ইলিশ। আমার ধারণা ছিল যারা লেখালেখি করেন তাদের রান্নার হাত ভাল হয় না। কারণ দুটো দু’ধরনের কেমেস্ট্রি। একই লোক বহু বিদ্যায় পারদর্শী হতে আমি কমই দেখেছি। নাসরিন জাহানের রান্নার হাত অপূর্ব তাঁকে দশে বারো দেয়া যায়। লাঞ্চ শেষে লেখিকার সাথে অনেক গল্প হল লেখালেখির গল্প, ঘর-কন্যার গল্প আর রাজনীতির গল্প ।

নাসরিন জাহান বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর মাজহারুল ইসলাম বললেন - হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে আছেন,যাবেন নাকি স্যারের সাথে দেখা করতে?

হুমায়ূন আহমেদের দেখা পাওয়া আমার কাছে তীর্থ দর্শনের মতো। বাংলাদেশে এসে আমার তীর্থ দর্শন হবে না এ আমি ভাবতেই পারি না। আমি বললাম - নিশ্চয়ই যাবো।

মাজহারুল ইসলাম বললেন কাল শুক্রবার, আমরা সকাল সকাল রওয়ানা দেবো, দুপুরে নুহাশ পল্লীতে গিয়ে লাঞ্চ করবো। স্যারকে আগে ভাগে কিছু জানানো যাবে না। হঠাৎ করে আমাদের দেখলে স্যার খুব খুশী হবেন।

স্যারকে আগে ভাগে কিছু না জানিয়ে এরকম হঠাৎ করে তাঁর আস্তানায় হাজির হয়ে তাঁকে সারপ্রাইজ দেয়া এ আমাদের অনেক পুরানো খেলা, অনেকটা শিশুদের পিকাপু খেলার মতো। কিছু না বলে-কয়ে সিলেটে শুটিং স্পটে যাওয়া কিংবা লন্ডন থেকে ফ্লাইট নিয়ে মাজহারুল ইসলামের নিউইয়র্কে স্যারের হোটেলে হাজির হওয়া- এ ধরনের সারপ্রাইজ আসলে এক বিরল ভালাবাসার অনুষঙ্গ। এটা এক ধরনের রসায়ন, হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি আসবার বিরল _সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল কেবল তারাই এই রসায়নের রসে আপ্লুত হয়েছিল।

পরদিন মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে লেখক-নাট্যকার শাকুর মজিদ, অভিনেতা কমল আর আমি, দলবেঁধে আমরা চললাম নূহাশ পল্লীর উদ্দেশে। পথিমধ্যে গাড়ি থামিয়ে স্যারের প্রিয় মিষ্টি আর বাচ্চাদের জন্যে কিছু চিপস কেনা হল। রাস্তায় জ্যামে পড়ায় আমাদের পৌঁছতে দুপুর তিনটা, তখন সবার লাঞ্চ করা হয়ে গেছে।

স্যার দুপুরে খানিকটা ঘুমিয়ে নেন। আমাদের দেখে স্যারের নিদ্রা টুটে গেল। আমরা সবাই তাঁর খুব প্রিয়। এতগুলো প্রিয় মুখ একসঙ্গে দেখে স্যার খুবই খুশী হলেন। কেয়ার টেকার বুলবুলকে দ্রুত রান্না ব্যবস্থা করতে বলে আমাদের জন্যে নিজ হাতে সরবত বানাতে লেগে গেলেন।

নূহাশ পল্লীর করমচা গাছে এবার প্রচুর করমচা ধরেছে, সকালে লোক জোগাড় করে এগুলো গাছ থেকে পারা হয়েছে। এখন জুসার দিয়ে জুস বানানো হবে। অনেক দিন ব্যাবহার না করায় জুস বানানোর মেশিনটা আর কাজ করছে না। স্যার বললেন মেশিনের খ্যাতাপুড়ি, দেশী জিনিস দেশী পদ্ধতিতে বানাতে হয়। তোমরা তো আর কোকাকোলা খাচ্ছ না যে মেশিনের দরকার হবে! দেখ আমি কি ভাবে বানাই…

হুমায়ূন আহমেদ বরফের অর্ডার দিয়ে পাঁচটা গ্লাস সাজিয়ে বসলেন, তারপর একটা একটা করে করমজা টিপে রস বার করতে লাগলেন। কাজটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে আমরা হেল্প করতে চাইলাম। স্যার কমল ছাড়া আর কাউকে এলাউ করলেন না।বারটেন্ডার হিসেবে কমল বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে।

স্যার জুস বানাতে বানাতে গল্প জুড়ে দিলেন - শোন আমি তখন আছি নর্থ ডকোটা স্টেট ইউনিভারসিতে। মিজান নামে আধ পাগলা ধরনের এক ছাত্র ঠিক করছে বাংলাদেশ নাইট করতে হবে। পনের দিন ধরে সে নানা ধরনের প্ল্যান-প্রোগ্রাম সাজাচ্ছে। মিজানের জন্যে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর ফোন - হুমায়ূন ভাই আপনার কি খিচুড়ি বানানোর রেসিপিটা জানা আছে? বাংলাদেশ নাইটের ফুড মেনুতে প্রধান খাবার থাকবে খিচুড়ি আর ডিম ভুনা। আমি বললাম - খিচুড়ির রেসেপি আমার জানা নেই।

মিজান বলে - তাহলে খিচুড়ি থাক, আনন্দ-উৎসবে খিচুড়িটা ঠিক যায় না। তা ছাড়া খিচুড়ির কালারের মধ্যে একটা গু গু ব্যপার আছে। খিচুরি আর গু দুইটা দেখতে প্রায় একই রকম। তারচেয়ে বরং কাচ্চি রিরিয়ানি করি। হুমায়ূন ভাই দয়া করে কাচ্চি রিরিয়ানির রেসেপিটা বলেন আমি লিখে রাখছি নয়তো ভুলে যাবো।

আমি বলি - শোন মিজান এক চা বানানো ছাড়া আমি আর কোন রান্না জানি না।

বলেন কি হুমায়ূন ভাই এত দিন ধরে আপনি আমেরিকায় আছেন, আমার ধারণা ছিল রান্নাবান্নায়আপনি একজন গ্র্যান্ড মাস্টার। কোন সমস্যা নেই, কাচ্চি বিরিয়ানির রেসেপি আমি ঠিক জোগাড় করে ফেলব। রাত চারটা বেজে গেছে আপনাকে আর বিরক্ত করছি না। দেখি আর কাকে ফোন করা যায়।

শাকুর মজিদ জিঙ্গেস করে - স্যার, সে সময়ে তো আপনাদের নর্থ ডকোটা স্টেট ইউনিভারসিতে খুব বেশি বাঙালী ছিল না। বাংলাদেশ নাইট করার চিন্তাটা আপনাদের মাথায় আসল কি করে?

শোন শাকুর, তোমাদের ধারনা যারা বিদেশে যায় তারা তাদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে যে তাদের বুঝি আর দেশের কথা মনে থাকে না। এরা বিদেশে যাবার সময় লুঙ্গি গামছার সাথে বাংলাদেশের বাজে রাজনীতিটা সঙ্গে করে নিয়ে যায় বটে কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় দেশের পতাকাটা উড়তে থাকে। যে মাটিতে মানুষ জন্মায় সে মাটির টান সে এড়াতে পারে না।

যাই হোক শোন, বাংলাদেশ নাইট উদযাপনটা আসলে আমার ইনুভারসিটিতে ছিল না ওটা ছিল আমার ওখান থেকে সাতশ মাইল দূরে মোরহেড স্টেট ইনুভারসিটিতে। মিজান সে ইনুভারসিটির একমাত্র ব্যাঙালী ছাত্র, একাউনটিংয়ে আন্ডার গ্রেজুয়েট কোর্স করছে। ওদের ইনুভারসিটিতে আন্তর্জাতিক বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অন্যান্ন দেশের সাথে উদযাপিত হবে বাংলাদেশ নাইট। সমস্যা হল মিজান ওর ইনুভারসিটিতে একমাত্র বাঙালী। ওর ফরেন স্টুডেন্ট এডভাইজার বলেছিল পাকিস্তানীদের সাথে মিলে সে যেন বাংলাদেশ নাইট উদযাপন করে। মিজান রেগে মেগে বলে এসেছে সে একাই বাংলাদেশ নাইট করবে।

আমি বললাম তারপর কি হল স্যার…

সেটাই বলছি শোন কি হলো - উৎসবের দিন ভোর বেলায় আমি আর মিজান মিলে প্রকাণ্ড এক সসপ্যানে খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম।

মাজহারুল ইসলাম বলল - খিচুড়ি কেন স্যার, আপনাদের তো ঠিক হয়েছিল কাচ্চি রিরিয়ানি রান্না করবেন।

স্যার বললেন - শোন মাজহার, আমি জানি তোমার বউ রানা-বান্না জানে না। তোমাকে প্রায়ই বাসায় রান্না-বান্না করতে হয়। রান্নার সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে তুমি বই লিখেছ ‘অন্যদিনের রান্না ঘর’। রান্নার বইয়ের জন্য বাসায় প্রায়ই ফটোশুট কর। ফটোশুট শেষ করে নানা আখাদ্য তুমি আমার বাসায় পাঠাও। তুমি নিচ্ছয়ই জান কাচ্চি রিরিয়ানি রান্না করা কত টাফ ব্যাপার। আমার ধারণা রান্নার সবচেয়ে কঠিন মেনু হচ্ছে কাচ্চি রিরিয়ানি। টমি মিয়া একবার আমাদের স্মোকড ইলিশ রান্না করে খাওয়াল, সে পর্যন্ত কাচ্চি রিরিয়ানি রান্না করতে ভয় পায়। বাসমতী চাল, মাংস আর মসলা একসঙ্গে মাখিয়ে রান্নার পাতিল ময়দা দিতে সিল করে দিতে হয় তারপর অল্প আঁচে আট ঘণ্টা ধরে সে রান্না চলে। পাতিলের ভিতরে কি হচ্ছে তোমার বোঝার কোন উপায় নেই। অভিজ্ঞ বাবুর্চি ছাড়া ভাল কাচ্চি রিরিয়ানি হবে না।…

আমার আর মিজানের অবস্থাটা তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পাড়ছ। ....প্রকাণ্ড সসপ্যানে চাল, ডাল, আনাজপাতি সেদ্ধ হচ্ছে। দুটো মুরগী কুচি কুচি করে কেটে ছেড়ে দেয়া হল। এক পাউন্ডের মত কিমা ছিল তাও ঢেলে দিলাম আর বাসায় যত ধরনের গরম মসলা ছিল সবই দিয়ে দিলাম। তারপর জ্বাল হতে লাগল। মিজান বলল - হুমায়ূন ভাই খিচুরির আসল রহস্য হল মিক্সিং যত বেশী ঘুঁটা দেয়া হবে জিনিস তত টেস্টি হবে। আপনি ভয় পাবেন না দেখবেন খিচুরি ভালই দাঁড়িয়ে গেছে।

মিজান একটা খুন্তি দিয়ে প্রবল বেগে ঘুঁটা শুরু করল। ঘণ্টা দুয়েক পর যা দাঁড়াল তা দেখে বুকে কাঁপন লাগে। ঘন সিরাপের মত একটা তরল পদার্থ তার ওপর আবার দুধের সরের মত সর পড়েছে আর রং হয়েছে কুচকুচে কালো। মিজান শুকনো গলায় বলল - খিচুরিটা কালো হয়ে গেল কেন বলুন তো হুমায়ূন ভাই? টমেটো কেচাপ দিয়ে দেব নাকি? আমি বললাম - দাও।

টমেটো কেচাপ দেয়ার পর খিচুরির রং আরো কালচে মেরে গেল। মিজান ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল - লাল রঙের কিছু ফুড কালার আছে সেটা ছেড়ে দেব নাকি? ফুড কালার দেয়ার পর রং যা দাঁড়াল তাতে আমাদের দুজনেরই মাথায় হাত। কাদা আর লাল রঙের সুরকি মেশালে সে পেস্ট হয় খিচুরি দেখতে হয়েছে অনেকটা সে পেস্টের মত। কথা ছিল মিজান অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে, নানা ব্যস্ততায় সে প্রাকটিস করার সুযোগ পায়নি। এখন ভয়ে তার গলা হয়েছে পাতি হাসের মতো। টেনশন কমাবার জন্য সে যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গান ধরল তখন মনে হল সর্দি লাগা পাতিহাস প্যাঁক প্যাঁক করছে।

স্যারের গল্প শুনে হাসতে হাসতে আমদের চোখে পানি আসার জোগাড়। শাকুর মজিদের হাসি আর থামতেই চায় না। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে শাকুর মজিদ বলল - তার পর কি হল স্যার?

মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যায়, বিকেলেই পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেল। আমরা অবাক হয়ে দেখি দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। মিজান নাকি আশে পাশের যত ইনুভারসিটি আছে সব ইনুভারসিটিতে বাংলাদেশ নাইটের খবর দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। আগে কেউ কনফারমড করেনি এখন একে একে ওরা আসতে শুরু করেছে।

দেড় হাজার মাইল দূরে মানটানো স্টেট ইনুভারসিটি, সেখান থেকে একটি মেয়ে গ্রে হাউন্ড বাসে করে একা একা চলে এসেছে। মিনেসোটা থেকে এসেছে দশ জনের একটা বিরাট দল তারা সঙ্গে নানা রকমের পিঠা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। গ্র্যান্ড ফোকস থেকে করিম সাহেব তার পুরু ফ্যামিলি নিয়ে চলে এসেছেন। তার স্ত্রী অসম্ভব কর্মঠ, এসেই মিজানকে বলল - এই গু-গোবর বাইরে ফেল, আমি নতুন করে রান্না বসাব চাল ডাল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তুমি আর হুমায়ূন আহমেদ খবর্দার রান্না ঘরের ধারে-কাছে আসবে না।

অনুষ্ঠান শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে চলে এলো সাউথ ডাকোটার ফলস স্প্রিং থেকে এক দল ছেলেমেয়ে। এসেই তারা মঞ্চে গান জুড়ে দিল - এমন দেশটি কোথায় খুঁজে পাবে নাক তুমি / সকল দেশের রানী সেজে আমার জন্মভূমি…গান শুনে মিজান শিশুর মতো কাঁদতে থাকে…পরদিন ওদের পত্রিকায় বাংলাদেশ নাইট নিয়ে একটা খবর ছাপা হল সেখানে সাংবাদিক ভদ্রলোক লিখেছেন…একটি অত্যন্ত আবেগ প্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, গান শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙালী ছেলেম্যেরা সব কাঁদতে শুরু করল। আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে এমন মধুর দৃশ্য আর দেখিনি…

‘বাংলাদেশ নাইট’ শিরোনামে আমার কিন্তু একটা লেখা আছে, পড়ে দেখ মজা পাবে। আচ্ছা এখন মিজানের গল্প থাক। বরফ এসে গেছে তোমাদের করমচার সরবতও রেডি। দাঁড়াও একটু গোল মরিচের গুড়া দিতে হবে সাথে বিট লবণ। হুমায়ূন আহমেদের গল্প শুনে আমাদের মনটা বেশ দ্রবীভূত হয়েছে। করমচার সরবত সেই দ্রবণে আরও ইন্দন যোগাল। সত্যিই, গল্প লেখা এবং বলার এক অনন্য কারিগর হুমায়ূন আহমেদ।

লাঞ্চ শেষে স্যার বললেন - পুকুর পাড়ে শাওনের নাটকের শুটিং চলছে আর টিভিতে শুরু হয়েছে বেদের মেয়ে জোছনা। এনজয় ইউরসেলফ, আমি একটু রেস্ট নিচ্ছি সন্ধ্যায় জম্পেশ আড্ডা হবে।

মাজহারুল ইসলাম আর শাকুর মজিদ চলে গেল নাটকের শুটিং দেখতে, আমি আর কমল বসে গেলাম বেদের মেয়ে জোছনা দেখতে। বাংলাদেশের একসময় সুপার হিট মুভি। কমল দুই মিনিটের মধ্যেই শুরু করে দিল তার বিখ্যাত নাক ডাকা। সস্তা ইমোশনের মুভি এখন আর মনকে টানে না। ড্রয়িং রুমের সেলফে স্যারের লেখা অসংখ বই। আমি ডুবে গেলাম হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের জগতে।

আজকে ফুলমুন না, তবুও আকাশ জুড়ে জ্যোৎস্না নেমেছে। অসংখ্য তারারা দ্যুতি ছড়িয়ে উন্মুখ হয়ে আছে যেন ওরা মর্ত্যের কোন দেবদূতকে প্রণতি জানাতে চায়। স্যারের সঙ্গে আমার এই প্রথম জ্যোৎস্না দেখা। আমরা সবাই গোলহয়ে লিচু তলায় বসেছি। শুরু হল গান। ক্ষুদে গানরাজে অংশ নেয়া একটা ছোট্র মেয়ে এসেছে সেদিন। মেয়ে তার মাকে নিয়ে দুদিনের জন্যে নুহাশ পল্লীতে বেড়াবে। ফোঁক গান দিয়ে শুরু - মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে, কান্দে হাসন রাজার মন ময়নায় রে। জুয়েল রানা গাইল, শাহ আব্দুল করিমের গান - কেন পিরীতি বাড়াইলারে বন্ধু ছাইড়া যাইবা যদি…

আমরা এসেছি বলে স্যার তার বয়াতি দলকে খবর দিয়েছিলেন, বয়াতির দল কয়েকটা মুর্শিদি গান করল। মেহের আফরোজ শাওনের গলার অবস্থা আজ ভয়াবহ খারাপ। শুটিংয়ের সময় প্রচুর চেঁচামেচি করতে হয়েছে। এখন তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না, তিনি কথা বলছেন ইশারায়। একে একে অনেকগুলো গান হল। হুমায়ূন আহমেদ আজ কেমন যেন একটু বিষণ্ণ, দুপুরের সেই উচ্ছাস আর নেই - যেন কোন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন বার বার।

শাওন ভাবী জিজ্ঞেস করলেন - আজ কি হয়েছে তোমার, শরীর খারাপ লাগছে?

আমরাও সবাই মিলে চেপে ধরলাম কি হলো হঠাৎ করে! স্যার যা বললেন আমরা কেউ তা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। স্যার বললেন - তোমরা সবাই হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রবীন্দ্র, নজরুল সবার গান গাইলে, হুমায়ূন আহমেদের গান কেউ করলা না!

গানের শিল্পীরা সবাই মাথা নিচু করে ফেলল। শাওন ভাবী তক্ষুনি একটা গান ধরল ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’ কিন্তু অন্তরায় গিয়ে ঝামেলা বেঁধে গেল। শাওনের ভাবীর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। বেচারার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। আমরা জুয়েলকে চেপে ধরলাম। সে ব্যাটা দশ বছর ধরে হুমায়ূন আহমেদের সহকারী পরিচালকের কাজ করছে, রাধা রমণের গান মুখস্ত করে বসে আছে কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের গান নাকি ওর জানা নেই, কি অদ্ভুত ব্যাপার! ক্ষুদে গানরাজে অংশ নেয়া ছোট্র মেয়েটা স্যারের গান না জানার দুঃখে রীতিমত কান্না জুড়ে দিল। আমরা সবাই একটা চরম অস্বস্তির মধ্যে পরলাম।

হঠাৎ অন্ধকারে মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে এসে কে যেন হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠল…
ও আমার উড়াল পঙ্খিরে, যা যা তুই উড়াল দিয়া যা
আমি থাকব মাটির ঘরে আমার চক্ষে বৃষ্টি পরে
তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা…

আমাদের সবার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গেল। হুমায়ূন আহমেদ বিস্ময়ে চিয়ার্স বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। গান শেষ হতেই সেই হেঁড়ে গলার লোকটিকে স্যার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই স্পর্শ এখনো আমার বুকে লেগে আছে। আমার সেদিনের সেই ধৃস্টতা ছিল একজন লেখককে স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়া। পরে স্যারকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যে তাঁর প্রায় সবগুলো গানই শিখে ফেলেছি। কিন্তু হায় আমার সেই স্রস্টা আর নেই! ফিরে ফিরে আমার সেই প্রিয় তীর্থ স্থানে আজকাল আর যাওয়া হয়না।
Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.