ছেলেবেলা থেকে শুরু করে প্রেম বিরহ, ভবঘুরে সন্ন্যাসী জীবন কি নেই এই উপন্যাসে! নিমিষেই নস্টালজিক ফিল করতে বাধ্য যে কোনো পাঠক। একটা কথা আছে না শরতে ডুবিলে কুল পাইবার জো নাই।
ছোটবেলায় "রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত " নামের মুভিটা অনেক বার দেখার পর সেখান থেকেই শ্রীকান্ত চরিত্রটা এত প্রিয়। যখন উপন্যাসটা পড়ছিলাম তখন ইন্দ্র চরিত্র টা এতটা আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়েছে যা সাময়িকের জন্য শ্রীকান্তের মোহ হতে বের করে আনছিলো। এই ইন্দ্র শ্রীকান্তের তারুণ্যের অনেকখানি সঙ্গী বলা যায়। লেখক তাকে এত সাহসী করে দেখিয়েছেন যে কিনা মাঝরাতে তরী নিয়ে একা একা মাছ ধরতে মাঝগঙ্গায় যেতেও দ্বিধা করতো না, যে কিনা ছিলো অসাধারণ বংশীবাদক, যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি উতরে যেতো যেকোনো সময় ,,আর যার মুখ থেকেই প্রথম উচ্চারিত হয় "মড়ার আবার জাত কি" ।আর তার কিছু সময়ের সাথী ছিলো এই শ্রীকান্ত।
ইন্দ্রের শখ ছিলো কিভাবে সাপুড়ে একজন মরা মানুষ কে বাঁচিয়ে তোলে, কিভাবে কড়ি চেলে সাপ ধরে আনে, কিভাবে সাপ খেলায় এগুলো শেখার আর সেই নিমিত্তেই সে অন্নদা নামের এক দিদির বাড়িতে যেতো যার স্বামী একজন সাপুড়ে, তাদের টাকা দিতো কিন্তু শেষমেষ বুঝতে পারে সবই ফাঁকি। এই অন্নদাদিদির বাড়িতে ইন্দ্রের সঙ্গে শ্রীকান্ত ও একবার এসেছিলো। দিদিকে দেখেই তার চোখ আটকে গেছিলো, মনে হয়েছিলো পৃথিবীর করুণ সুন্দর মুখখানি বুঝি বিধাতা অন্নদাদিদিকে দিয়েছেন। তারপর হঠাৎ একদিন দিদি হারিয়ে যায়,,, কিন্তু শ্রীকান্ত শেষ পর্যন্ত দিদিকে ভুলতে পারে নি,এক ই সাথে পাই না ইন্দ্রের খোঁজ।
তার বহুকাল পরে রাজপুত্রের সাথে শিকারে যাওয়ার নিমন্ত্রণে দেখা হয় এক বাঈজীর সাথে,, নাম পিয়ারী। এই পিয়ারী সেই রাজলক্ষ্মী যে ছেলেবেলায় বঁইচিফুলের মালা গেঁথে শ্রীকান্ত কে দিতো। যদিও তখন সেটার ভিন্ন অর্থ ছিলো তবুও সেখানে যে রাজলক্ষ্মীর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না সেটা লেখক বুঝতে পারে বহুবছর পরে। এমনি করে মান অভিমান হাসি কান্না দিয়েই দিন যায়। একদিন রাজলক্ষ্মীও নিজ পথে চলে যায় আর শ্রীকান্ত হয়ে যায় ভবঘুরে। যাপন করে সন্ন্যাসী জীবন। কেনো কোন কারণে এই বেশ তা লেখক নিজেও জানতে পারে নাই হয়তো।
এই রাজলক্ষ্মী কে শ্রীকান্ত অন্নদাদিদির প্রতিরূপ মনে করতো। সেই করুণ সুন্দর মুখ,,, রাতের জ্যোৎস্নালোকের ন্যায় স্বচ্ছ। এই রাজলক্ষ্মীকে যে শ্রীকান্ত ভালোবাসতো তা কি শ্রীকান্ত সেই সময় বুঝতে পারে নাই? তবে কেনো হলো এক পতিতার জন্য সন্ন্যাসী?
মানুষের দ্বারে ভিক্ষা করে,, মানুষের সেবা করে যখন সে ক্লান্ত রোগে শোকে জর্জরিত,, সেই মরণাপন্ন সময়ে রাজলক্ষ্মী তাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে। এই সময়ে লেখক অনুভব করে " যে গোপনে আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু এই নিশীথে সে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই জানিতে পারিল না। " কি সুগভীর ভালোবাসা, হৃদয়ে যাদের এত ব্যথা বাজে তারা কিন্তু জগত সংসার কে তুচ্ছ করে স্বাধীন হয়ে একে অপরের সাথে বাঁচতে পারত। কিন্তু এখানেই বুঝি তফাৎ রাজলক্ষ্মীর জন্যই রাজলক্ষ্মী কে ছাড়িয়া গিয়াছিলো শ্রীকান্ত।
"বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না -ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোট খাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না -এই সুখেশ্বর্য পরিপূর্ণ স্নেহ -স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য আমাকে আজ একপদ ও নড়াইতে পারিত। "
শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্র ই খুব উজ্জ্বল। হোক সেটা নতুনদা ,রতন কিংবা রাজলক্ষ্মী র সতীন পো বঙ্কু বা খোট্টার ঘরে বিয়ে হওয়া সেই তেওয়ারী কন্যা।
যেহেতু প্রথম খন্ড সেহেতু জানা হয়নি অনেক কিছুই, কেনো রাজলক্ষ্মীর এই বাঈজী জীবন,কোথায় হারিয়ে আছে ইন্দ্র, অন্নদাদিদি,আর কি দেখা হয় শ্রীকান্ত -রাজলক্ষ্মীর?
লেখিকা: তায়্যিবা তাবাসসুম