মূলত বইটা একটা গল্পের বই! মোট এগারোটি গল্প আছে বইটিতে। প্রত্যেকটি গল্প নিয়ে আলাদা আলাদা যদি বলতে যাই, এই লিখা অনেক বড় হয়ে যাবে, তাই আমি যা বলছি, বলা যেতে পারে টুকরো টুকরো ভালো লাগা গুলোর ছিঁটেফোঁটা। তবুও যে বড় হবে না, তার কোনো নিশ্চিয়তা নেই!
প্রথমেই গল্প গুলোর ভেতরে ঢোকা যাক। এগারোটা গল্পের ভেতর আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে -
"পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার"।
আমাদের কর্পোরেট দুনিয়ায় কতো রকম গল্প আছে। তার কিছু ঠকানোর, কিছু ঠকে যাওয়ার। উপরে উঠতে গিয়ে আমরা কতো মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাই অথবা খেতে হয়, তার কেবল একটা উদাহরণ হয়তো আছে এই গল্পে। এই গল্প পড়তে গিয়ে আমি ভাবছিলাম কি ভীষণ প্রতিযোগিতা আমাদের ভেতর! উপরে উঠে যাওয়ার অথবা কেবলমাত্র টিকে থাকাই কি আমাদের লক্ষ? তাতে কার কি হলো,কার লাভ হলো, কার ক্ষতি হলো, অথবা নৈতিকভাবে আমাদের অবস্থান কই গেলো, আসলেই কি আমাদের কিছু আসে যায় তাতে?
তারপর বলতে হয়, অপ্রসিয়মানতির গল্পের কথা৷ মূলত এই গল্পে, সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর, সন্তান কে ঘিরে বাবা মায়ের যেই অসহায়ত্ব তৈরি হয়, যেই অধিকারহীনতার তৈরি হয়, লেখক সেই ব্যাপারে কথা বলেছেন। বলেছেন বাবা মায়ের দিক থেকে! যদিও উল্টোপাশের কিছু বক্তব্য তো থেকেই যায়, তবু, আমার কাছে গল্পটাকে খুব জীবন্ত মনে হচ্ছিলো, যেনো বাস্তব! খুব বাস্তব! আর আসলে এমনটাই ঘটে, ঘটছে এখন!
ঠিক এই গল্পটার কাছাকাছি একটা গল্প "মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান পরিষ্কার"। মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে বাঁচাতে সন্তানের আঁকুতি, সঙ্গে কিছু চরম বাস্তবতা এইখানে ফুটিয়েছেন শাহাদুজ্জামান। দেখিয়েছেন, দৈনিক বিল চল্লিশ হাজার টাকা অথচ পিতা ভীষণ কষ্টে আছে, ওই অবস্থায় সন্তানের যে টানাপোড়েন। বাবার লাইফ সাপোর্ট খুলবে কি খুলবে না!!
তারপর যদি আসি, "ওয়ান ওয়ে টিকিট" গল্পে। এইটি ঠিক ফিকশন হয়েও নন ফিকশন লাগছিলো আমার কাছে। ফিকশন এর ভেতর দিয়ে নন ফিকশন। গল্প ছিলো দেশ ছাড়া বিষয়ক রফিকুল আলম এর অনিচ্ছা সংক্রান্ত বিষয়ে। আমেরিকার ভিসা হাতে থাকা সত্ত্বেও সে যাচ্ছিলোই না, কিন্তু গল্পের শেষে তাঁকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু কিভাবে? সেইটাই এই গল্প! সব সময়ে রিটার্ন টিকেট সঙ্গে নিয়ে যাওয়া রফিকুল আলম, এবার কেনো কিনলেন ওয়ান ওয়ে টিকেট?
এইরকম আরো সাতটা গল্প আছে, উবার, মামলার সাক্ষী ময়না পাখি, জৈনিক স্তন্যপায়ী প্রাণী যিনি গল্প লেখেন,নাজুক মানুষের সংলাপ, লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে, চিন্তাশীল প্রবীন বানর, টুকরো রোদের মতো খাম!
পুরো বইটা এমন না যে ধরলাম আর শেষ করলাম। বই এর ভেতর অনেক ধরনের ভাবনা চিন্তার খোড়াক আছে। পড়তে হবে, ভাবতে হবে, ভাবতে গেলে অনেক কিছু আবিষ্কার হবে এমন! বইটা যখন কিনছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো বইটার দাম একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পড়ার পর মনে হয়নি তেমন। ঠিক ই আছে। গল্পগুলো অসাধারণ।
তবে, এই বইয়েও কিছু গল্প আছে সাধারণ, যদিও- লেখক তার কিবোর্ড এর যাদুতে সাধারণ গল্প গুলোকে সাজিয়েছেন অন্য রকম করে। পড়ে মনে হয়না সাধারণ, ভাবতে গেলে ভাববার বিষয় থাকে। আমার কাছে এমন লিখা ভালো লাগে, ফিকশন, তবে অবাস্তব না। বাস্তবতাকে গল্পের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়েছেন, মনে সন্দেহ তৈরি হবে, এইটা বাস্তব না কি কেবল ই গল্প! অথবা কোনো কোনো গল্প পড়ে মনে হবে, না এইটা তো আমার পাশের ই ঘটনা, এইটা সত্য। অথচ এইটা কেবল ই একটা গল্প! এই বই এর বিশেষত্ব আমার কাছে এইটাই।
প্রকাশনি ছিলো প্রথমা। তেমন কোনো ভুলত্রুটি আমার চোখে পরে নি। শুধু দামটা ছাড়া। লেখক শাহাদুজ্জামানের তৃতীয় বই পড়লাম। ওনাকে আবিষ্কার করতে পেরে ভালো লাগছে। যারা শুধু পড়তে চান না, ভাবতে চান, বাস্তবতা খুঁজতে চান, তারা নিঃসন্দেহে এই বইটি পড়েই ফেলতে পারেন!
লেখক: তাশদীদুল আলম সাইম