অ্যাসবেসটস - নীরব ঘাতক ক্যান্সারের কারণ

অ্যাসবেসটস - নীরব ঘাতক ফুসুফুস ক্যান্সারের কারণ। অনেকে দেশে ব্যবহার নিষিদ্ধ। সাশ্রয়ী বলে বাণিজ্যিক উৎপাদন হয়। অযাচিত ব্যবহার ঝুঁকির কারণ হয় পৃথিবীতে

অ্যাসবেসটস হলো সিলিকেট জাতীয় এক ধরনের খনিজ। অ্যাসবেসটস থেকে আণুবীক্ষণিক সাইজের সুতার মত বস্তু বের হয়, যা নিশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। অ্যাসবেসটসের ভয়াবহ ক্ষতিকারক দিকগুলোর কারণে অনেক দেশেই এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে উৎপাদনশীলতায় সহজলভ্য ও সুবিধাজনক বৈশিষ্টের ফলে বানিজ্যিকভাবে অ্যাসবেসটস উৎপাদন বন্ধ হচ্ছেনা। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই চলছে ক্ষতিকর অ্যাসবেসটসের অবাধ ব্যবহার। 


অ্যাসবেসটস - নিরব ঘাতক ক্যান্সারের কারণ - Asbestos - the silent killer cause of cancer


অ্যাসবেসটস কি

অ্যাসবেসটস হলো সিলিকেট জাতীয় একপ্রকার প্রাকৃতিক খনিজ, যা ছয়টি সিলিকেট উপাদানের একটি সেট। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে রেশমের সাথে অ্যাসবেসটসের মিল পাওয়া যায়। টেক্সটাইল ফাইবার হিসেবে এর বহুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। মাটির তলদেশে কঠিন শিলা স্তরে স্তরে জমা হয়ে একপ্রকার ফাইবারের সৃষ্টি করে তৈরি হয় অ্যাসবেসটস। এলুমিনিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, সিলিকেটসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে অ্যাসবেসটস এ। প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে খনি থেকে অ্যাসবেসটস আহরিত হতো, তবে ঊনিশ শতকের পর থেকে বানিজ্যিকভাবে এটির উৎপাদন ক্রমিক হারে বৃদ্ধি পায়।

অ্যাসবেসটস এর ব্যবহার

রেশম ও পশম বৈশিষ্ট্যযুক্ত হওয়ায় টেক্সটাইল ফাইবার হিসেবে অ্যাসবেসটস জনপ্রিয়। খনিজ ফাইবারকে যান্ত্রিক চাপ প্রয়োগ করে তৈরি করা হয় শিট। অ্যাসবেসটস আঁশ থেকে তৈরি করা হয় সুতা। বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন শব্দ ও শোষণ ক্ষমতা, গড় প্রসার্য শক্তি ও অগ্নি নিরোধক, তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিক ক্ষতি প্রতিরোধক হওয়ায় এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। অ্যাসবেসটসে মরিচা ধরেনা এবং এসিডে ক্ষতি হয়না। অগ্নি নির্বাপক বৈশিষ্ট্যের কারণে অ্যাসবেসটস ব্যবহার হয় ফায়ার ফাইটারদের স্যুট তৈরিতে, থিয়েটার পর্দা, পাইপ ও তামার তারের আবরণ, তাপ ও শব্দ প্রতিরোধক দেয়াল ইত্যাদিতে। ঘরের চালায় সাধারণ স্টীল টিন ও সিমেন্ট শিটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয় অ্যাসবেসটস শিট। শিল্প কারখানা,  জাহাজ ও বিমান নির্মাণে এটির ব্যবহার দেখা গেছে।

অ্যাসবেসটস - নীরব ঘাতক ক্যান্সারের কারণ

দীর্ঘদিনের অ্যাসবেসটস এর সহচার্য ফুসফুসের ক্যান্সার, মেসোথেলিয়মা, মেয়েদের ওভারিয়ান ক্যান্সার এবং অ্যাসবেসটোসিস এর মতো ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি করে। অ্যাসবেসটস থেকে নির্গত অতিক্ষুদ্র আঁশ নিঃস্বাসের সাথে প্রবেশ করে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। অ্যাসবেসটসের ধুলো ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিনের অ্যাসবেসটস ব্যবহারে ফুসফুস ও পাকস্থলীতে ক্যান্সার হয়। অ্যাসবেসটস শিটের তৈরি চালা থেকে সংগৃহীত বৃষ্টির পানি পানের ফলে দৈহিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। পরিবেশ দূষণের অন্যতম অকল্যাণকর একটি উপাদান অ্যাসবেসটস। অনেক ক্ষেত্রে চুলকানির মতো চর্মরোগের উপসর্গও দেখা দেয়। বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় ও বেসরকারি গণমাধ্যমে অ্যাসবেসটসের ক্ষতিকারক দিক, ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্নচিত্ত খবর প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা গেছে বেশিরভাগ মানুষই জানতেন না অ্যাসবেসটস কতটা ক্ষতিকর। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা জেলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে অ্যাসবেসটস শিটের বহুল ব্যবহারের ফলে অত্র এলাকাগুলোতে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানা গিয়েছে। ১৯৪০ সাল থেকে পেশাজনিত রোগের অন্যতম একটি কারণ অ্যাসবেসটস। অ্যাসবেসটসের ফলে অন্যান্য যেসব রোগ হয় যেমন: প্লুরাল ইফিউশন, প্লুরাল প্ল্যাকাস, প্লুরিসি, ডিফিউজ প্লুরাল থিকেনিং ইত্যাদি।

অ্যাসবেসটস নিষিদ্ধকরণ ও অযাচিত ব্যবহার

ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যাসবেসটস নিষিদ্ধ করেছে ২০০৫ সালে। তবে রাশিয়া, ক্যানাডা, ব্রাজিল, জিম্বাবুয়ে, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে বন্ধ হয়নি এর অযাচিত ব্যবহার। সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী মুল্যের কারণে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো অবাধে ব্যবহার করছে অ্যাসবেসটস, কোনোপ্রকার স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রতিরোধ ছাড়াই। ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা বিভিন্ন সম্মেলনে এটির ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা ও ক্ষয়ক্ষতির বার্তা দিয়েছে। অ্যাসবেসটস সারা পৃথিবীতেই পাওয়া যায়, তবে প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম রাশিয়া, কাজাখস্তান ও চীন। একসময় উত্তর আমেরিকাতে এই ক্ষতিকর খনিজের প্রচুর উৎপাদন হতো। 

বিশ্বব্যাপী অ্যাসবেসটস এর ঝুঁকি

অ্যাসবেস্টস অল্প পরিমাণও নিরাপদ নয়। সাধারণত সবচেয়ে খারাপ প্রভাব তখন পড়ে, যখন কেউ দীর্ঘদিন অ্যাসবেসটসের সংস্পর্শে থাকে। অ্যাসবেস্টস ধীরে ধীরে শরীরে জমা হয়ে যে ক্ষতিসাধন করে তা নিরাময় করা প্রায় অসম্ভব। 
বায়ুবাহিত বলে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্য দিয়ে মানুষকে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত করে। যারা অ্যাসবেসটস খনির আশেপাশে বসবাস করে তাদের অতিসত্বর উচিত সেই স্থান এড়িয়ে চলা। অ্যাসবেসটস ব্যবহারকারীদের উচিত এটির ব্যবহার দ্রুত পরিহার করা। অ্যাসবেস্টস সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী হয় ৬০ বা তার বেশি বয়সের পুরুষ। কারণ অ্যাসবেস্টস সম্পর্কিত সমস্যা দীর্ঘ সময়কাল ধরে প্রভাব ফেলে। ফলে কখনো কখনো উপসর্গ প্রকাশ পেতে কয়েক দশক সময় লেগে যায়। 

এজেন্সি ফর টক্সিক সাবস্টেন্স অ্যান্ড ডিজিজ রেজিস্ট্রি'র মতে প্রায় ২ মিলিয়ন শ্রমিক ১৯৪০ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে কেবলমাত্র শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত অ্যাসবেস্টস পণ্যের ঝুঁকির সংস্পর্শে ছিলো। বর্তমানে, নির্মাণ ও সাধারণ শিল্পে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন শ্রমিক অ্যাসবেস্টস এক্সপোজারের ঝুঁকিতে রয়েছে।



Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.