মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস মানেই স্বপ্নভাঙার উপন্যাস, মোহভাঙার উপন্যাস।
"পুতুলনাচের ইতিকথা" উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। ইহা তার অনবদ্য এক সৃষ্টি। ব্রিটিশ যুগের গ্রাম সমাজের মানুষের জীবনধারণের পটভূমি নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। যেখানে জমিদারি - ভূসম্পত্তির মালিকানা, দালালি - মহাজনী ইত্যাদি ব্যবসা নির্ভর মানুষের পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষেরাও রয়েছে। এই গ্রাম সমাজে অন্ধবিশ্বাসের পাশাপাশি কুসংস্কারেরও জয়জয়কার বিদ্যমান।
পুতুল নাচের ইতিকথা কাহিনী সংক্ষেপ
উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়, এক বজ্রাঘাতে খালের ধারে প্রকান্ড বটগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হারু ঘোষের মৃত্যু দিয়ে। হারু ঘোষ গাওদিয়া গ্রামের বাসিন্দা। গাওদিয়া ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামটি ধনী, মধ্যবিত্ত ও হতদরিদ্র মানুষের বসবাসে গড়ে ওঠে। গ্রাম সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য - অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞতা, পরচর্চা, কুসংস্কার ইত্যাদিও গাওদিয়ার গ্রামীণ সমাজে দেখা যায়। শিক্ষিত তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠ পর্যন্ত এতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
শশী কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে আসা একজন ডাক্তার। কলেরা, ম্যালেরিয়া কিংবা অন্য যে কোন অসুখ হলে সকলে দৌড়ে আসে শশীর কাছে। শশীও সবসময় নিজেকে গ্রামের মানুষের সেবায় নিয়োজিত রাখে। এভাবে সে অনেক মানুষের জীবন বাঁচায়।
গাওদিয়া গ্রামে সাদাসিধে জীবনযাপন করা মেয়ে বিন্দুবাসিনী, বিয়ের পর জীবনের অজ্ঞাত রহস্য তাকে গ্রাস করে ফেলে। বিন্দুরও ইচ্ছে করে স্বামী নন্দলালের ভালোবাসা পেতে। নন্দলাল বিন্দুকে তার রক্ষিতার মতোই ভালোবাসে। নন্দলাল বিয়ের পর গাওদিয়ার সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে। এর পেছনে এমন কী কারণ লুকিয়ে আছে যার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে শশীর বোন বিন্দুকে?
কুসুম, যে খুবই চঞ্চলা প্রকৃতির নারী। তার মুখ কখনো আটকায় না। যখন মুখ দিয়ে যা আসে তা-ই সে মুখ ফসকে বলে দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে পরাণের সাথে সংসার করছে। সে মনেপ্রাণে শুধু একজনেই ভালোবাসে। সে আর কেউ নয়, পরাণের ডাক্তার বন্ধু শশী। যে শশীর জন্যে কুসুমের এত ভালোবাসা, সেই গভীর ভালোবাসা কী শশী কখনো বুঝতে পেরেছিল? হ্যাঁ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিল। শেষমেশ কুসুমকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল বহুদূর। কুসুম কী তার ভালোবাসার মানুষটার এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বহুদূর চলে যাবে? নাকি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করে পরাণের সংসারে থেকে যাবে?
পরাণের বোন মতি একজন সহজ-সরল মেয়ে। তার স্বপ্ন অফুরন্ত। মতির ইচ্ছে, একদিন বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। তার পরনে থাকবে ঝকঝকে শাড়ি, গলায় থাকবে ঝলমলে গহনা। ঘরের কাজকর্ম কিছুই সে করবে না। এভাবে সারাটা জীবন পার করে দেবে। ইচ্ছেটা কী শেষ পর্যন্ত পূরণ হবে?
শশীর আরেক বন্ধু হচ্ছে কুমুদ। তারা দু'জন একসাথে কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ত। কুমুদের কাছে জীবনের অর্থই হচ্ছে জীবনকে উপভোগ করা। জীবনকে নিয়ে খেলাধুলা করায় তার কাজ৷ নেই কোন লক্ষ্য, নেই কোন উদ্দেশ্য, পুরোই অনিশ্চিত ও স্বপ্নহীন জীবন। কথার জাদুতে মানুষকে বশ করতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে সে জন্মেছে। এমনিভাবে গাওদিয়ায় এসে সে একজনকে ভালোবাসার জালে আটকে ফেলে। যাকে সে তার মতোই করে গড়ে তুলতে চায়। সেই মেয়েটি কে? মেয়েটা কী ভালোবাসার মানুষের ছন্নছাড়া জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? নাকি দুমড়েমুচড়ে যাবে?
ধার্মিক ও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গ্রামের মানুষের কাছে যাদব পন্ডিতের বেশ নাম ঢাক আছে। অন্ধবিশ্বাসের ফাঁদে মানুষকে আটকে রেখে সে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে জানে। "সামনের রথের দিন যাদব পন্ডিত মারা যাবে।" - এই কথা চারিদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার পর পন্ডিতমশাইকে দেখতে পাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষের ঢল নামে। রথের দিন ঠিকই যাদব পন্ডিত ও তার স্ত্রী পাগলদিদি মৃত্যুবরণ করেন। এর পেছনের কারণটা নাহয় বই পড়ে জেনে নিবেন।
পুতুল নাচের ইতিকথা পাঠ প্রতিক্রিয়া
ইতোমধ্যে পুতুলনাচের ইতিকথা আমার পড়া প্রিয় বাংলা বইয়ের মধ্যে আলাদা একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। সামাজিক উপন্যাসগুলোর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা মানুষের জীবনের সাথে অনেকাংশে মিলে যায়। সেদিক থেকে পুতুলনাচের ইতিকথাও ব্যতিক্রম নয়। মানুষের জীবনটাই পুতুলের মতো। প্রকৃতি তাকে যেভাবে নাচানো হয়, সে সেভাবেই নাচে। এই উপন্যাসেও শুধুমাত্র দুয়েকটা চরিত্র ছাড়া বাকি চরিত্রগুলো পুতুলের মতো নেচেছে। আমার কাছে যাদব পন্ডিতের জীবনটা একদমই পুতুলের মতো মনে হয়নি। নিজের ইচ্ছায় সে সঞ্চালিত হয় বলে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পেরেছিল। যদি বলা হয় কোন চরিত্রটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটা চরিত্রকে বেছে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। কেননা লেখক এখানে প্রতিটি চরিত্রকে এত যত্নসহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন, একটা চরিত্রকে বাদ দিয়ে অন্য আরেকটা চরিত্রের পক্ষ হয়ে কথা বলা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। গ্রামীণ সমাজের মানুষের মাঝে যেসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তার সবটুকু লেখক নিখুঁতভাবে বর্ননা করেছেন। তাই উপন্যাসটাকে নিঃসন্দেহে পছন্দের উপন্যাস বলা যায়।
পুতুল নাচের ইতিকথা বইয়ের বাহ্যিক প্রসঙ্গে
শক্তপোক্ত বাইন্ডিং আর সাধারণের মধ্যে গর্জিয়াছ প্রচ্ছদ মিলিয়ে সব ঠিকঠাক। পৃষ্ঠার মানও বেশ ভালো। এটা নীলক্ষেত প্রিন্ট নয় তাই পড়তে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের প্রয়োজন হয়নি।
রিভিউ লেখক: মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম