দাজ্জাল এর আবির্ভাব, গুজবের অতীত ও বর্তমান

দাজ্জাল বা এন্টিক্রাইস্ট এর এই গুজবটা তৈরি করেছে একজন খৃষ্টান সাধু, সেন্ট জন। পরবর্তী ২০০০ বছর ধরে প্রচুর মানুষ এই গুজবটা বিশ্বাস করে করে বিভ্রান্ত হয়
দাজ্জাল গুজব অতীত ও বর্তমান

জহিরুল ইসলাম: 

দাজ্জাল আসলে কি?

দাজ্জাল বা এন্টিক্রাইস্ট এর এই গুজবটা তৈরি করেছে একজন খৃষ্টান সাধু, সেন্ট জন। পরবর্তী ২০০০ বছর ধরে প্রচুর মানুষ এই গুজবটা বিশ্বাস করে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে।

সে অনেককাল আগের কথা।

আনুমানিক - ৬০ খৃষ্টাব্দ। (আজ থেকে ১৯৬২ বছর আগে) রোমের রাজা তখন কাইজার নিরো।

 "রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাশি বাজাচ্ছিল"

 প্রবাদটা মনে আছে? সেই কাইজার নিরো। এই নিরো ছিল বহু দেবতায় বিশ্বাসী। রোমে তখন একেশ্বরবাদী খৃষ্টানরা কেবল ঢুকতেছে। নিরো এই খৃষ্টানদের প্রচন্ড অত্যাচার করতেন।

(SA-TV তে প্রচারিত আসহাবে কাহাফ নামক টিভি সিরিয়ালে সেই সময়ে খৃষ্টানদের অত্যাচার এর বর্নণা পাওয়া যায়)

খৃষ্টানদের তখনকার ধর্মগুরু - John ( হিব্রু উচ্চারন -ইউহান্না) কে নির্জন দ্বীপে জেলখানায় পাঠিয়ে দিল কাইজার নিরো। জেলে বসে বসে জন একটা বই লিখল। বইটার নাম বুক অফ রিভিলেশন। বইয়ের মধ্যে লেখা আছে, " একদিন আমি ঘুমিয়েছিলাম। তখন যীশু স্বপ্নে দেখা দিল আমাকে। যীশু বললেন, খৃষ্টানদের সামনে এখন ঘোর বিপদ। এক অত্যাচারী পশু /এন্টি ক্রাইস্ট এসে সকল বিশ্বাসী খৃষ্টানদের উপর অনেক অত্যাচার করতেছে। এই পশুটা হল 666. সে ভবিষ্যতে আরো অনেক নির্যাতন করবে। তবে তোমরা ভয় পেয়ো না। কারন এই এন্টি ক্রাইস্ট কে ধ্বংস করার জন্য আমিই পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাব। তোমরা ধৈর্য ধরো। "

ঘটনা বুঝতে পেরেছেন? বাংলাদেশে বসে যেমন অনেকে বাংলাদেশের দুর্নীতির কথা না লিখে উগান্ডার দুর্নীতির কথা বলেন, সেইরকম ইউহান্নাও সরাসরি কাইজার নিরোর সমালোচনা করতে পারেন নি। তিনি 666 এর বদনাম করেছেন?

কে এই 666?

প্রতিটা এলফাবেটের বিপরীতে নিউমেরিক নাম্বার বসানোর একটা নিয়ম আছে অনেকগুলা ভাষায়। যেমন A= 1, B= 2, C= 3 এইরকম। আরবিতে একে বলে আবজাদ ভ্যালু। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম এর আবজাদ ভ্যালু হচ্ছে 786,যেটা বাংলাদেশে খুবই ব্যবহৃত হয়। স্কুলে পরীক্ষার খাতায় সবার উপরে 786 লিখে তারপর লেখা শুরু করতাম।

হিব্রু ভাষায় Kaiser Nero অক্ষরগুলার আবজাদ ভ্যালু 666.

সাধু ইউহান্না 666 বা এন্টি ক্রাইস্ট বলতে কাইজার নিরো'কেই বুঝাইছে। ( এবং সেই নিরো মরে ভূত হয়ে গেছে ৬৮ সালে।)

এন্টিক্রাইস্ট এর চোখ মাত্র একটা, বা তিনি একচোখা লিখে সাধু ইউহান্না সম্ভবত বুঝিয়েছিলেন, রাজা একচোখা নীতি পালন করছে। মূর্তিপূজক প্যাগান প্রজাদের প্রতি তিনি সদয়, কিন্তু খৃষ্টান দের প্রতি নির্দয়।এন্টিক্রাইস্ট সম্পর্কে এমন আরো অনেক রুপক কথা আছে বুক অফ রিভিলেশনে।

পরবর্তী যুগে খৃষ্টানরা বুক অফ রিভিলেশনকে তাদের বাইবেলের মধ্যেও ঢুকিয়ে নিয়েছে। ( বাইবেলের। মধ্যে বিভিন্ন মানুষের লেখা এইরকম 60+ বই আছে)। অনেকে বিশ্বাস করেন, ইউহান্নার 666 অতীতে চলে যায়নি, ভবিষ্যতে আসবে আবার।

666 নিয়ে ইলুমিনাতি এবং আরো অনেক হাবিজাবি ভবিষ্যতবাণী করে খৃষ্টান জ-ঙ্গীরা। অনেকে তাদের কথা বিশ্বাস ও করে।


২.

বাইবেলের কিছু কিছু জিনিস হুবুহু নকল হয়ে ইসলামি এসকাটোলজিতেও ঢুকে গেছে।

আবু হুরাইরার মত কয়েকজন ভুয়া হাদিস বা জাল হাদিস স্পেশালিস্ট এর হাত ধরে দাজ্জাল বা কেয়ামত সম্পর্কিত অনেক কিছু হাদিসে চলে এসেছে ( ভিন্নভাবে বললে, বাইবেলের বর্ননাই তারা একটু চেঞ্জ করে, বলেছে, আমি মহানবী (সা) কে এই কথা বলতে শুনেছি। এভাবে বাইবেলের বর্ননাই হাদিসে চলে এসেছে )

এন্টি ক্রাইস্ট এর ইকুইভ্যালেন্ট 'দাজ্জাল' নামে একটা জিনিস পাওয়া যায়। বাইবেলের বর্ননায়, এন্টিক্রাইস্ট এর কপালে 666 লেখা থাকবে। হাদিসের বর্ননায়, দাজ্জালের কপালে আরবিতে কাফের লেখা থাকবে।

এই দাজ্জাল এর নাকি এক হাতে থাকবে দোজখ, আরেক হাতে থাকবে বেহেস্ত। সে যাকে ইচ্ছা তাকে বেহেস্তে বা দোজখে ঢুকিয়ে দিতে পারবে, সে মৃতকে জীবিত করতে পারবে, পশুপাখির ভাষা বুঝতে পারবে, মাটির তলায় কিনাছে দেখতে পাবে ইত্যাদি । ( নিশ্চয়ই রুপক অর্থে লিখেছে, অথবা পুরাটাই রুপকথা লিখেছে)

একইভাবে, দাজ্জালের জন্ম হবে ভেড়ার পেটে, দাজ্জালের একটা মাত্র চোখ থাকবে -এমন কথাও প্রচলিত আছে।

এন্টিক্রাইস্ট এর বিপরীতে বাইবেলে যেমন ক্রাইস্ট পাওয়া যায়, ইসলামি এসকাটোলজিতে আবার ইমাম মাহাদিকে পাওয়া যায়।

ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র - 

কোরআন শরীফে দাজ্জাল বা ইমাম মাহাদি সম্পর্কে কিছুও নাই। শুধুমাত্র কিছু হাদিসেই পাওয়া যায়। ( যেগুলা কে জাল হাদিস বলে দাবী করেন অনেকে)

হাদীসের যে বর্ননাগুলা পাওয়া যায় দাজ্জাল সম্পর্কে, সেগুলার সাথেও ৬৮৩ এবং ৬৯২ সালের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার মিল পাওয়া যায়। ওই সময় ইয়াজিদ এর সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) এর যুদ্ধ হয়েছিল। কাবা ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তখন ইয়াজিদ।

পরবর্তী সময়ে অনেকে দাবি করা শুরু করেন, দাজ্জাল, এবং ইমাম মাহাদি সম্পর্কিত যা যা হাদিস, সেগুলা ৬৮৩ সালের কোনো ঘটনা নিয়ে নয়। এগুলা ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার ভবিষ্যৎবাণী।

যে যেভাবে পারে, এই হাদিসগুলা ইউজ করছে। নিজেদের মত করে সম্পাদনা করে নিচ্ছে।হিযবুত তাওহিদ নামের একটা দল দাবি করছে, দাজ্জাল কোনো মানুষ নয়, এটা একটা দেশ। আর সেই দেশ হচ্ছে আমেরিকা। আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইমাম মেহেদি হচ্ছেন হিযবুত তাওহিদ এর নেতা বায়েজিদ খান পন্নী এবং হুসেইন মোহাম্মাদ সেলিম।

ইসলামিক স্টেট দাবি করে, দাজ্জাল এখনো আসে নাই, আসবে শীঘ্রই। ইমাম মেহেদির আবির্ভাব হবে সিরিয়ার দাবিক নামের এক গ্রাম থেকে ( ওই গ্রামটা আইএস এর কন্ট্রোলে) ।

গত বছর বুয়েটের এক ইঞ্জিনিয়ার, মুশতাক মুহম্মদ আরমাম খান মুন্না দাবি করেছিলেন, ইমাম মেহেদি আসবে মক্কা থেকে। ( মুশতাক খান তখন মক্কায় ছিলেন)। যে যেভাবে পারে, হাদিসকে কাটা ছেড়া করে ব্যবহার করছে। 

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সিনেমার কয়েকজনের এক চোখ কানা দেখিয়ে নতুন এক কন্সপাইরেসি থিওরি এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। লোকজনও ভালই প্রচার করছে। হাজার হাজার লাইক কমেন্ট পাচ্ছে এই কন্সপাইরেসি থিওরি টা। তানজিল সিরাজ অনঘ সহ অনেকেই একচোখা দাজ্জাল এর এই কন্সপাইরেসি থিওরি টা ট্রল হিসেবে শেয়ার করছেন। তবে লং রানে এই কুসংস্কার টা সমাজে ক্ষতি করতে পারে।

মধ্যযুগে 'ডাইনী' সন্দেহে অনেকে মেয়েকে পুড়িয়ে খুন করত পাদ্রীরা,কিংবা সাধারন কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনতা। 

ফ্রান্সের জোয়ান অফ আর্ক বোধ হয় সবচয়ে বিখ্যাত উদাহরণ। দাজ্জাল এর এই একচোখা গল্প জনগন বিশ্বাস করলে দেখা যাবে, এক চোখ অন্ধ বা ত্রুটিপূর্ণ ( লক্ষীট্যারা, চশমার এক চোখে পাওয়ার বেশি ইত্যাদি) সবাইকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাবলিক সন্দেহের চোখে দেখছে, বা গনধোলাই দিচ্ছে, কিংবা কথিত ডাইনীদের মত পরিনতি বরন করতে হচ্ছে।

কয়েক বছর আগে র‍্যাব খুব ভাল একটা কাজ করেছিল। ৯০ পৃষ্ঠার একটা বই বের করেছিল, সেটার পিডিএফ ওদের ওয়েবসাইটে এভেইলেবল। এই বইতে কোরান -হাদিসের বিভিন্ন স্পর্শকাতর আয়াতের সঠিক ব্যখ্যা দেওয়া হয়েছে।জিহাদ, গাজওয়া,কালো পতাকা সহ অনেক বিষয়ই এসেছে সেখানে। পড়ে দেখতে পারেন ।




তথ্যসূত্র -

১. কতিপয় বিষয়ে জঙ্গীবাদীদের অপব্যাখ্যা এবং পবিত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা -র‍্যাব কতৃক প্রকাশিত

২. জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা - পারভেজ আলম

৩. The story of God with Morgan Freeman- TV serial

৪. উইকিপিডিয়া ( https://en.m.wikipedia.org/wiki/Number_of_the_beast)

৫. বাইবেল -নিউ টেস্টামেন্ট - বুক অফ রিভিলেশন


Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.