অনুবাদ ও অনুকথন: অজিত মিশ্র
প্রকাশক: অমৃতলোক সাহিত্য পরিষদ, ডাকবাংলো রোড, মেদিনীপুর।
প্রথম প্রকাশ: কলিকাতা পুস্তক মেলা জানুয়ারি,১৯৯১
দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ: কলিকাতা পুস্তক মেলা জানুয়ারি,১৯৯৩
প্রচ্ছদ: প্রণবেশ মাইতি
মুদ্রণ মূল্য: ৪০ টাকা।
অনুবাদকের উৎসর্গ-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লেবাননের বসহেরিতে পাহাড় ঘেরা এক ছোট্ট শহরে ১৮৮৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন কহলিল জিব্রান। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে যেমন ওঠানামা দেখা যায় তাঁর জীবনেও ছিল। তবে জন্মের পর থেকেই তিনি একটা সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন যে পরিবেশ ছিল নির্জন প্রাকৃতিক অনুপম শোভায় ঘেরা। তিনি মাত্র ৪৮ বছর বেঁচে থাকলেও এই স্বল্প সময়ে তিনি জীবনটাকে চিনতে পেরেছিলেন । তবে জিব্রানের জীবন খুব সহজ ছিল না কারণ তার জন্মের আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে ছিল। এর মধ্য থেকেও তরুণ বয়সে জিব্রান ছবি এঁকেছেন, কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধও লিখেছেন। পারিবারিক সুত্রে তাকে আমেরিকায় চলে আসতে হয় আর সেখানেই শিশু বয়স থেকে ধর্মীয় ভাবনার মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছেন জিব্রান। বিশ শতকের শুরুর থেকেই তার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে প্রকাশ হয়েছে।
১৯২১ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে যখন ভেঙে পড়েছে সমস্ত মূল্যবোধ। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে গিয়েছে পরমসত্তার প্রতি বিশ্বাস হালকা হয়ে গেছে ঠিক তখনই তিনি লিখেছিলেন দ্য প্রফেট।
বিভিন্ন গুণীজন এই বইয়ের আলোচনায় লিখেছেন, এই বইটি কাব্যগ্রন্থ নয়, ধর্মগ্রন্থ নয়, দর্শন শাস্ত্র নয় আবার এগুলো সবগুলো নিয়ে যেন নতুন কিছু।
সম্পূর্ণ বই পড়ে মনে হল এখানে এমন এক মুক্তির কথা বলা হয়েছে যে মুক্তির জন্য মৃত্যুর পরে নয় বরং জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের মধ্যেই এই মুক্তি সম্ভব।
একজন মানুষের জীবনের সাথে যা কিছু প্রভাব বিস্তার করে তার অধিকাংশ এমনকি সবকিছুই এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে। সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য পুরো বইয়ের সকল আলোচনা হয়েছে কাব্যিক ছন্দে, যে ছন্দ হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়।
এই বইটা কে আমি চন্দন কাঠের সাথে তুলনা করছি। চন্দন কাঠ যেমন যত ঘষা যায় তার সৌরভ ততো বের হয়। এই বইটি ঠিক তেমন একবার পড়লেও ভালো লাগবে আবার বারবার পড়লেও ভালো লাগবে। সাথে সাথে ভাবনাগুলো আরো বিস্তৃত পাবে।
বইয়ের শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে ভালোবাসা বিষয়ে। ভালোবাসা মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা খুব স্বল্প কথায় আলোকপাত করা হয়েছে। কোন মানুষ সম্পূর্ণ হতে হলে অবশ্যই ভালোবাসা প্রয়োজন। তবে ভালবাসার ক্ষেত্রে ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কোনো চাহিদা থাকলে তার জন্য ভালোবাসার এই ক্ষেত্রে পা দেয়া অর্থহীন।
ভালোবাসা দেয় না কিছু, শুধু নিজেকে ছাড়া;
ভালোবাসা নেয় না কিছু, শুধু ভালোবাসা ছাড়া।
ভালোবাসা অধিকার করে না কিছুই, না তাকে অধিকার করা যায়;
কেননা, ভালোবাসা সুসম্পন্ন ভালোবাসাতেই...!
ভালোবাসার পরেই স্থান পেয়েছে বিবাহ বিষয়ে। বিবাহ সম্পন্ন হলেও একজন অন্যজনের ওপরে নির্ভর না হয় এবং একজন আরেকজনকে যেন শৃংখলাবদ্ধ না করে ফেলে। শিশুদের বিষয়ে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন সকল পিতা-মাতার উচিত শিশুকে নিজের মতো করে বড় হওয়ার স্বাধীনতা দেয়া।
জিব্রান মনে করতেন জমিয়ে রাখা মানেই ধ্বংস ডেকে আনা। বাঁচতে হলে মানুষকে দান করতে হবে। আর সেই দান হবে শূন্যের দিকে অর্থাৎ কোন কিছু না ভেবে দান করতে হবে। তিনি প্রকৃতির কাছে পেয়েছেন এই শিক্ষা।
প্রায় বলো তুমি, দেবো, আমি সবই দেবো তাকে-
যার বেশি প্রয়োজন আছে।
এরকম বলে না তো বৃক্ষেরা কখনও
এরকম বলে না তো খামারের পালিত পশুদল।
তারা দান করে তারা বাঁচতে চায় বলে,
কেননা জমিয়ে রাখা মানেই তো ধ্বংস ডেকে আনা।
কাজ বিষয়ে তিনি বলেছেন যে, পুরো বিশ্ব যে গতীর সাথে চলছে, কোন ব্যক্তি যখন কোন কাজ করে তখন সেই গতির সাথে নিজেকে যুক্ত করা হয়। আর তখন মানুষ হয়ে ওঠে বাঁশি আর তার ফিসফিসানি হয়ে ওঠে সংগীত। এভাবেই তিনি কাব্যের ছন্দ দিয়ে জীবনের প্রতিটি বিষয়কে স্পর্শ করেছেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে দেখা যায় মৃত্যুর পরে নির্বাণ লাভের কথা কিন্তু মৃত্যুর পূর্বেই এই জীবনে নির্বাণ লাভের পথ দেখিয়েছেন কহলিল জিব্রান। তিনি মানুষের মাঝেই যেন মানুষের স্বর্গ দেখতে পেয়েছেন।