আহমদ ছফা বাংলাদেশের লেখক সমাজের মাঝে অন্যতম সম্পদ কিন্তু প্রচারবিমূখ একটি নাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা প্রেক্ষাপট কিংবা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অনিয়মের কথাই বলেন সে বিষয়ে তাঁর লেখায় খুব সুক্ষ্মভাবে তিনি তা তুলে ধরেছেন । যেমন ওঙ্কার ; মাত্র আটত্রিশ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস কিন্ত লেখক এবং পাঠক সমাজে জন নন্দিত একটা লেখনী। অল্পকথায় সংলাপ বিহীন কথকের বণর্নায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা। আলোড়ন তুলেছে সকল মানুষের মাঝে।
ওঙ্কার শব্দটি মূলত হিন্দু-পূরাণ থেকে নেয়া যার অর্থ হচ্ছে আদি ধ্বনি বা সকল ধ্বনির মূল।
লেখক উপন্যাসটির নাম কেনো ওঙ্কার রেখেছেন কেন সেবিষয়ে মূল আলোচনায় হয়তো জানা যাবে। তবে সে বিষয়ে জানবার আগে একবার আহমদ ছফা কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে কোন উপন্যাসটিকে ক্লাসিক উপন্যাস হিসেবে মনে করেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন ওঙ্কার। ওঙ্কারের ছিলনা চিরাচরিত সাহিত্যরথিদের দেয়া আয়তন বা শব্দের সীমাবদ্ধতা। ছিলনা উপন্যাসের চিরাচরিত সংলাপ। তবে বড় গল্প হিসেবেও ওঙ্কারকে কেউ উল্লেখ করেনি। সমালোচনার চেয়ে ওঙ্কার নিয়ে ছিল সবার উচ্ছ্বাস, কোলাহল আর করতালি।
ওঙ্কার কাহিনী সংকক্ষেপ
ওঙ্কার সেসময়কার ঘটনা গুলো আলোকপাত করা হয়েছে যে সময়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে তৈরী হয় ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র। আর সে সময়ে জমিদারি প্রথা তখনও বিলুপ্ত হয়নাই। তবে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হয় সাথে তালুকদারি প্রথাও। আর কথকের বংশধরেরা ছিলো তালুকদার। আর সে রক্ত কথকের বাবার ধমনিতেও প্রবাহিত। মানুষকে শোষণ করা কিংবা নীচু মনেকরা ছিলো তখনকার এসব মানুষদের স্বভাব। মানুষকে ফাঁদে ফেলে কিভাবে নিজের স্বার্থ হাসিল করা যায় সে বিষয়ে তারা ছিলো অনেক এগিয়ে আর এসব বিষয়ে মামলা মোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যে সাক্ষী হাজির করা এবং কার্যসিদ্ধি করা কিন্ত যখন তাদের ক্ষমতা খর্ব হয় তখন তাঁরা হয়ে পরে পঙ্গু।
ওঙ্কারে লেখক জমিদারি শোষক শ্রণীর কথা খুব সুন্দর ভাব তুলে ধরেছেন। আবার যখন এই শোষকেরা আরেক শোষকের পাল্লায় পরে তখন তাদের আর কিছু করার থাকেনা। তেমনই একজন প্রতারক আবু নসরের পাল্লায় পরে কথকের পরিবার। আর দুর্বিসহ অবস্থায় কথকের পরিবারকে সাহায্য দেয়ার বিনিময়ে কথককে বিয়ে করতে হয় আবু নসরের বোবা মেয়েকে।
ক্ষমতারও পালাবদল ঘটে! রাজ্য চলে যায় রাজারও পরিবর্তন ঘটে। তবে সে পরিবর্তন ঘটার আগে যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যখন সামরিক শাসন চালু হয় আয়ুব খান তখন সেনাপতি। খান সেনাদের দাপটে আবু নসরদের মতো প্রতারকরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে, মিডিয়ায়ও এদের আনাগোনা বেড়ে চলে। আবু নসরও ঠিক সেরকম । সে আইয়ুব খানের চেলা বনে যায় আর বিনিময়ে কথকও সে সুবিধা ভোগ করে কারন আবু নসরের জামাই বলে কথা। কিন্ত সে সুবিধা বেশিদিন ভোগ করা হয়না। তবে এর মাঝে কথকও আছে মানসিক বিড়ম্বনায়। বোবা মেয়েকে বিয়ে করে তাঁর জীবন বিষিয়ে ওঠে। এ থেকে পরিত্রান আর পাওয়া হয়না। বোনের সাথে কথা বলে কথকের মানসিক একটু প্রশান্তি ঘটে এরপর একসময় সে তাঁর ছোটবোনের জন্য গানের শিক্ষক ঠিক করে।
গানের শিক্ষকের কাছে তালিম নেয়ার কারনে কথকের বোন অল্পদিনের মাঝেই খুব ভালো গান গাওয়া শিখে ফেলে কিন্তু এরমাঝে একদিন কথক লক্ষ্য করে তাঁর বোবা বউটিও পাশে হারমোনিয়ামের সাথে গোঁ গোঁ করে গাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এরই মাঝে বিপত্তি ঘটে যায়! পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আসাদ নামক একজন ছাত্র শহীদ হয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পরে চারদিক। মিছিল হয় মাঝে মাঝেই। মিছিলে কথক অনেক ভয় পায় কারন শোষকদের সহায়তায় আজকে সে চাকরি পেয়েছে আর যে বাড়িটিতে কথকের বসবাস সে বাড়িটিও হিন্দু ব্রাঞ্জনের থেকে দখল করা। তার শ্বশুর এসব করে দিয়েছে। সে ভয় কথকেরও হয়। শ্বশুরের অপরাধ সেও নিজেকে অংশীদার মনে করে। এদিকে আসাদের শহীদের পর সংঘর্ষ বাধে, আবার মিছিলও হয় কথকের বাড়ির এদিকেও। কথক মাঝে মাঝেই জানালা বন্ধ করে রাখে যাতে মিছিলের আওয়াজ না আসে কিন্ত তাঁর বোবা বউ এসব কর্ণপাত করেনা সে মিছিল আসলেই জানালা খুলে দিয়ে মিছিল শোনার চেষ্টা করে। একদিন কথক লক্ষ্য করে তাঁর বোবা বউ মিছিল বাড়ির যতই সামনে আসে আর সে গোঁ গোঁ থেকে বা.....বার বলার চেষ্টা করছে। এর কিছু সময় পর মিছিলের আওয়াজ আসে বাংলাদেশ, কথক বুঝতে পারে তার বউ কি বলার চেষ্টা করছে। এর কিছু সময় পর তাঁর বউয়ের মুখ থেকে শুনতে পায় বাংলা এরপরই দেখতে পায় তাঁর বউ মাটিতে পরে গেছে, মুখ থেকে গড়ে গড়ে লাল রক্ত পরছে।
কথক তা দেখে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কার রক্ত বেশি লাল শহীদ আসাদের নাকি তাঁর বোবা বউয়ের!?
লেখক অসাধারণ একটা সমাপ্তি টেনে এনে দেখিয়ে দিয়েছেন এদেশের আপামর জনতা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কতটা উদগ্রীব, কতটা ব্যাকুল! একটা বোবা মেয়েও সে চেতনা লালন করে।