পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা "মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম" বেশ আলোচিত একটি ইতিহাস নির্ভর বই। এটিকে আমি অন্যান্য বইয়ের থেকে 'স্বতন্ত্র'ই বলতে আগ্রহী । লেখক অন্ততপক্ষে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে বিকৃত ইতিহাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় নি। বরং যুগের পর যুগ বিকৃত ইতিহাসের নিচে চাপা পড়া সত্যটাকে বোমা ফাটিয়ে বিস্ফোরণ করে বইয়ের মোড়কে উপস্থাপন করেছেন। যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। একজন পাঠক কোনো বই পড়ার আগে স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে প্রশ্ন করতে পারে, কেন তার বইটি পড়া উচিৎ? অর্থাৎ একটি বই পড়ার পর সে এমন কিছু জানতে পারবে কিনা যা তার অজানা ছিল ! এমন কিছু বিশ্লেষণ থাকা চাই, যা একজন পাঠককে কোনো বিষয়ে ধারনা দেবে অথবা কোনো প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়ের বিশ্লেষণ থাকবে ! মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম বইটিতে এমন অনেক বিষয়ে "যৌক্তিক বিশ্লেষণ" করা হয়েছে যা অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।অজানা ছিল অনেকের কাছে । বইটিতে এমন অনেক বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়েছে। যেমন,
( ১) মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ইসলামিক দলগুলো এবং মুসলিম বিশ্বের ইসলামি নেতাদের স্বধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের অবদান কেমন ছিল তা বইটিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে ! বিশ্লেষণ করা হয়েছে একাত্তরের সবটা সময় জুড়ে যুদ্ধাদের ইসলামি মনোভাব।
(২) মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তানী সহচর রাজাকার এবং আজকের 'তথাকথিত' রাজাকারদের অবয়ব যে রাত- দিনে তফাৎ, তা 'মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম' বইটিতে উঠে এসেছে গুরুত্ব সহকারে । কিন্ত তার অজানা কারন যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিকৃত করা হয়েছে সে অভিযোগও ব্যাখ্যা করেছেন লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য !
(৩)যুদ্ধের সয়ম রাজাকার'রা কেন রাজাকার বনে গেল ? কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে তারা রাজাকার বা শান্তি কমিটিকে যোগ দিয়েছিল , সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য। যে বিশ্লেষণটি অন্যান্য অনেক বইতে এক তরফা ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
(৪) মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বজনীন নিন্দিত ''বাকশাল" প্রতিষ্ঠার সময় দেশের সব রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করা হলেও একটিমাত্র ইসলামী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়নি ! তার কারন কি? বহুলপ্রচলিত এই প্রশ্নটির 'যুক্তিসংগত বিশ্লেষণ' দেওয়া হয়েছে বইটিতে ।
(৫) বর্তমান সময়ের আলোচিত বক্তা আল্লামা মামুনুল হকের পিতা আল্লামা আজিজুল হক (র:) এর অবদান মুক্তিযুদ্ধে কেমন ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আজিজুল হক (রঃ) এর সম্পর্ক কেমন ছিল তা আজকের ভাস্কর্যপন্থীরা বইটি পড়লে জানতে পারতো। আফসোস তারা সম্ভবত পড়ে নি।
(৬) ছয় দফায় উত্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের তিন নীতি ( সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক অধিকার) কেন মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ সময়ে এসে পরিবর্তন হয়ে চার নীতিতে ( ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ) রুপান্তরিত হলো এবং এর পেছনে ভারতের অবদান কতটুকু !
(৭) সেকুলারিজম ও বাংলাদেশকে ভারতের 'স্বীকৃতি' নিয়েও তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইটিতে ।
বইটিতে এমন অনেক প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। যা অনেকের কাছে হয়তোবা অস্পষ্ট ছিল!
শেষকথা : মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম বইটি প্রকৃতপক্ষেই অতুলনীয় । আমি প্রথমে ভেবেছিলাম লেখক পিনাকী ভট্টাচার্যের মতো একজন আধা নাস্তিক সোস্যাল এক্টিভিস্ট মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে কি আর এমন বিশ্লেষণ করবে তার বইতে ! কিন্ত আমায় বোকা বানিয়ে যুগের পর যুগ "বিকৃত ইতিহাসের" নিচে চাপা পরে হারাতে বসা 'ইতিহাস'-ই টেনে বের করে আনলেন তিনি। যেগুলো কোনো অজানা কারনে কোনো এক গুষ্টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিকৃত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আজও।
© ফখরুল ইসলাম সৌরভ।