স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার৷ এই অধিকারে দাসত্বের শৃঙ্খলে অন্যধীন হয়ে না থাকা মানুষের মৌল চেতনা৷ এই চেতনাকে অবমূল্যায়ন করলে অভ্যুত্থান তো হবেই৷
১৯৪৭ সালে হাস্য পরিহাসের দেশভাগে স্বাধীনতার নামে বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে এক পিঞ্জর থেকে মুক্ত করে বন্দি করা হলো আরেক পিঞ্জরে৷ সেই পিঞ্জরের নাম পশ্চিম পাকিস্তান ;
ধর্মের নামে যারা ছিলো অত্যাচারী শোষকশ্রেণী৷ সাংস্কৃতিক আঘাতে তারা বাংলা ছাড়া মুসলমান বানাতে চেয়েছিলে আমাদেরকে৷ ২৪ বছরের নিপীড়নে বাদ যায়নি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক কোনো ক্ষেত্রের শোষণ। বাংলায় ফলা সোনালি আঁশে সোনা হতো ইসলামাবাদ। প্রশাসনিক উচ্চপদে ছিলো না কোনো বাঙালি। উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করা হতো না কোনো বাঙালি সামরিক অফিসারকে৷ পূর্ব পাকিস্তানে তৈরী কাগজ তাদেরকেই কিনতে হতো দ্বিগুণ দামে৷ আমলাতান্ত্র সিকি ভাগও বাঙালিদের অধিকারে ছিল না৷ দীর্ঘদিনের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর৷ ৬৯ এর মিছিলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, সাজেন্ট জহুরুল হক ও ড. জোহাকে হত্যা গণঅভ্যুত্থানকে দেয় রসদ, যেন আগুনের মধ্যে বারুদের যোগান৷ এই প্রেক্ষাপটেই রচিত 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসটি৷
জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আত্মসর্বস্ব, আত্মসন্ধানী, অস্তিত্ববাদী চরিত্র ওসমানের নিজেকে মেলে ধরা চেতনাস্রোতেই নদীর মতো বয়ে চলেছে প্রেক্ষাপট। নদীর এক তীরে রাজনৈতিকভাবে উত্তল শহর ঢাকা, অন্য তীরে শ্রেণিবৈষম্যের সংঘাতে গ্রামীণ জনপদের দুরবস্থা। নদীর বাঁকে বাঁকে রয়েছে আত্মপ্রেমের আহবানে স্বনামী রঞ্জুর প্রতি টান, আবার আত্মপ্রেম বিসর্জনের আহুতি, রানুর প্রতি গোপন প্রেমের আকাঙ্ক্ষা, আলতাফ ও আনোয়ারের পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ, সামরিক জান্তার স্থানীয় প্রতিনিধি বাড়িওয়ালা রহমতুল্লাহ, আলাউদ্দিন মিয়া, শোষকশ্রণির উৎখাতের স্বপ্নে হাড্ডি খিজিরের উন্মত্ততা, গ্রামের শোষকগোষ্ঠী ও সর্বহারা কৃষকশ্রেণি ইত্যাদি৷ সমান্তরাল রেখাদের যেমন কখনো মেলবন্ধন হয় না তেমনি সমান্তরাল সংঘর্ষেও যার লড়াই সেই লড়ে মুক্তি পেতে চায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জাতীয় মুক্তির পথ উন্মুক্ত হলেও গ্রাম ও শহরের সাধারণ জনজীবনের রূপরেখা কোনো পরিবর্তন হয়নি।
শহুরে রাজনীতিকদের মুখের বুলিতে ফোটে জাতীয়তাবাদী এক্য ও সম্প্রীতি, গ্রামীণ জীবনের দুঃখ দুর্দশা তাদের কাছে মূখ্য নয়৷ আবার গ্রামের মজলুম জনগোষ্ঠী তাদের প্রতি দীর্ঘদিনের অত্যাচারের প্রতিবিধান করতে উন্মুখ, সেখানে জাতীয় সংহতির ভূমিকা বুঝতে তারা অবোধ৷ অন্যদিকে মধ্যবিত্তের আত্মবিশ্লেষণে ৬৯ একটি সংখ্যায় চিহ্নিত তালেবের লাশ মাত্র।
লেখক সম্পর্কে দুয়েকটা কথা :
জীবন যেখানে যেমন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনা সেখানে ঠিক তেমনই। কোনো বাহুল্য নেই, আবার ঘাটতিও নেই। মাত্র দুইটি উপন্যাস, কয়েকটি ছোটগল্প ও একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল তারকা তিনি৷ হারে নয়, মানের নিরীখে উঁচু মাপের লেখক তিনি৷